শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৩

একটি অনাকাংখিত বাস্তব ঘটনা

এই ব্লগটি যখন লেখতে বসেছি তখন আমি অসুস্থ । তারপরও লেখতে বসেছি ।ঘটনার সময়কাল এই বছরের মার্চ মাসের ১১ তারিখ রাত সাড়ে এগারটা । এই রাতটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনাকাংখিত দুর্ঘটনা ।
আগে আমার পরিচয় দিয়ে নেই । আমি মোঃ মাসুম,কিশোরগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র । আমি একজন সাধারন ছাত্র।রাজনীতির ধারে কাছেও যাই না ।মার্চ মাস আমাদের ৫ম পর্ব সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে ।তখন সারা দেশে যুদ্ধাপরাধিদের বিচার নিয়ে বিএনপি,আওয়ামি লীগ,জামাতের মধ্যে অনেক জামেলা চলছে ।হরতাল,অবরোধ,গনজাগরন মঞ্চ সব মিলিয়ে সারাদেশ উত্তাল । আমি কলেজের কাছে জেলা সড়কের পাশে একটা মেছে থাকি ।১২ তারিখ আমাদের একটা পরীক্ষা ছিল কিন্তু হরতালের কারনে পরীক্ষাটা এপ্রিলের ২৫ তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়েছে ।তাই অনেকটা হালকাই লাগছিল ।বইটা শেষ করা বাকি ছিল তাই পড়ছিলাম ।রাত তখন ১১.৩০ মিনিট । ঘুম আসছিল তাই আমি আর আমার বন্ধু শুয়ে পড়লাম ।মাত্র চোখের পাতা দুইটা এক করেছি,ঠিক তখনি মেছের ভিতরে চিতকার চেচামেচি শুরু হয়ে গেল । আমি আর খাইরুল বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামলাম,দৌড়ে বাহিরে এসে দেখি সবাই রাস্তায় একটা সিএনজির পিছনে চুটছে । একজনকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল প্রনভ কে নাকি চিনতাইকারিরা ধরে নিয়ে গেছে । প্রনভ আমার মেছের ছোট ভাই ।আমরা মেছে তিন সেমিষ্ঠার মিলিয়ে প্রায় ৩৫ জন থাকি ।৩৫ জনের মধ্যে আমি সহ মাত্র ১১ জন সিনিয়র । এই কথা শোনার পড় আমিও সবার সাথে সিএনজির পিছে চুটলাম ।একটু সামনে যাবার পড় সিএনজির সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়তে পারলাম না । সিএনজি চলে গেল । আমাদের সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য তা পড়েই বুজতে পারবেন । ঠিক তখনি একটা মাহিন্দ্র সিএনজি আমাদের দিকে আসছিল । আমরা গাড়ি থামিয়ে ভিতরের সব যাত্রি নামিয়ে আমরা আমরা প্রায় ১৫ জনের মত সিএনজিতে ওঠে পড়লাম । সিএনজিতে ওঠে ড্রাইভারকে সবকিছু সংক্ষেপে বলে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম । আমরা প্রায় ১ কিঃমিঃ সামনে গিয়ে সিএনজিটা দেখতে পেলাম।সিএনজির ভিতর থেকে কে জানি টর্চ দিয়ে রাস্তায় আলো ফেলছিল।  তখন ও যদি বুঝতে পারতাম কি ঘটতে যাচ্ছে  তাহলে সিএনজি থেকে নেমে দৌড় দিতাম । সিএনজিটা গিয়ে একটা পুলিশের গাড়ির সামনে থামল । আমরা ভাবলাম পুলিশের গাড়ি সিএনজিটাকে থামিয়ে দিয়েছে । সিএনজি থামার সাথে সাথে সবার আগে আমি নামলাম ।সিএনজি থেকে নেমেই দেখি এক পুলিশ আমার দিকে দৌড়ে আসছে । আমি ভয় না পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ।কারন আমি কোন অপরাধ করি নি তাই ভয় পাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না । কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে পুলিশটি আমার শার্টের কলার ধরে ফেলল ।
-স্যার এক শালাকে ধরেছি ।
-শালাদের ভ্যানে তোল ।
আমি তখন ওদেরকে আমাদের কথা শোনার জন্য অনুরোধ করছিলাম আর ওদেরকে বোঝাতে চেষ্ঠা করছিলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা পুলিশ আমাদের সাত জনকে ধরে ফেলল আর অন্যরা যারা ছিল দৌড়ে পালিয়ে গেল । আমাদের ধরে পুলিশ মারতে মারতে ভ্যানের দিকে নিয়ে চলল । মার খাওয়ার পড়ও আমি বার বলছিলাম,
-আমাদের কথা শুনুন,আমাদের কোন অপরাধ নেই ।আমরা কি করেছি যে আমাদের এভাবে মারছেন ?
-শালা পুলিশের সাথে মস্তানি, আজকে তোদের মস্তানি বের করব ।
আমি তো এখানে ভদ্র ভাষা ব্যবহার করছি । কিন্তু আমার মনে হয় না যে এমন কোন অশ্লিল গালি বাকি আছে যে ওরা আমদেরকে দেয় নি ।
যাই হোক আমার বন্ধু সজিব ও দৌড় দিয়েছিল,কিন্তু আমাদের চিৎকার শুনে ও দৌড়ে আসল । ও আসার সাথে সাথে পুলিশ ওকে ধরে ফেলল । যাই হোক ওরা আমাদেরকে মারতে মারতে ভ্যানে তুলল । আমি ভ্যানের শেষ প্রান্তে ছিলাম ।আমাকে সিভিল ড্রেস পড়া একজন পুলিশ বাইরে থেকে একটা লাটি দিয়ে মারতে শুরু করল ।করিমগঞ্জ থানার একজন পুলিশ আমার পরিচিত ছিল । সে আমাকে ভিতর থেকে বন্দুকের বাট দিয়ে মারতে শুরু করল আর বলতে শুরু করল কিরে মাসুম তোকে না ওদিন বুঝিয়ে আসলাম,তারপরও এরকম করলি কেন ? এই কথা বলার কারন হল, আমার ছোট ভাই এক ছেলের সাথে ঝগড়া লেগেছিল । এই সময় পুলিশ ওখান দিয়ে যাচ্ছিল । ঝগড়া  দেখে পুলিশ মিটিয়ে দিতে আসলে আমি আমার ছোট ভাইয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলাম । সেই থেকে ঐ পুলিশের সাথে আমার পরিচয় । আমাকে চেনা সত্ত্বেও ওনি যে আমাকে কেন মারলেন বুঝতে পারলাম না ।যাই হোক কতক্ষন মারধর করার পর ভ্যান থানার দিকে যাত্রা শুরু করল । ভ্যানে বসে বুজতে পারলাম পুলিশের সাথে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে । আমরা ছিনতাইকারি ভেবে পুলিশের পিছনে লেগেছি,আর পুলিশ আমাদেরকে পিকেটার মনে করে আমাদের ওপর এভাবে আক্রমন করেছে । পড়ে মেছে এসে জানতে পেরেছিলাম,ঘটনার রাতে আমাদের মেছের ৩য় পর্বের সিদ্দিক ১ম পর্বের ২ ছোট ভাইকে দোকানে পাটিয়েছিল । করিমগঞ্জ থানার পুলিশ রাতের বেলা সিএনজি দিয়ে রাতের বেলা টহল দেয় । ওরা ফিরে আসার সময় ওদের সামনে একটা সিএনজি এসে দাড়াল । সিএনজির ভেতর থেকে একজন হাত বাড়িয়ে এক ছোট ভাই প্রনভকে পুলিশ ধরে ফেলল । আর এদিকে সৌরভ কিছু না দেখে দৌড়ে মেছে চলে আসে,আর বলে যে প্রনভকে ছিনতাই কারি ধরে নিয়ে যাচ্ছে  সিএনজিতে করে । এই কথা শুনে সবাই দৌড়ে মেছ থেকে বের হই । আর আমাদের কে  দূর থেকে রাস্তায় দেখে দুই পুলিশ এক দোকানের আড়ালে লুকাল,আর দুই পুলিশ সিএনজি করে পালিয়ে যেতে চাইল । কিন্তু ওরা যদি একবার রাস্তায় নেমে দাড়াত তাহলে আর কোন সমস্যাই হত না । আসলে সত্যি কথা হচ্ছে আজকের দিনের পুলিশের মনেও সৎ সাহস নেই । ওরা ভেবেছে আমরা হরতাল করতে নেমেছি । আসলে ঘটনাটা সম্পূর্ন ভুল বোঝাবুঝির কারনে ঘটেছে । এখন থানার ঘটনায় ফিরে যাই,আমাদের কে ভ্যানে বসিয়ে পুলিশ গালিগালাজ করছিল আর আমরা ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম । ওরা আমাদের বলছিল যে ওরা আমাদেরকে শিবির বলে কোর্টে চালান করে দিবে । আমরা যখন থানার একবারে কাছে চলে এসেছি তখন ঘটল এক অভূতপূর্ব ঘটনা । থানার একবারে সামনেই একটা ব্রিজ ছিল । ব্রিজটাই ওঠার আগে একটা ছোট মোড় আছে । জায়গার অভাবে এক পুলিশ ভ্যানের পা দানিতে দাড়িয়ে ছিল । গাড়িটা যেই মোড় ঘোরাল,দাড়িয়ে থাকা পুলিশ সাহেব ভ্যান থেকে পড়ে গেল । তখন ভ্যান থামিয়ে সব পুলিশ নেমে গেল ।মাত্র একজন পুলিশ ভিতরে ছিল । আমরা ভ্যান থেকে দেখতে পেলাম আশে পাশের মানুষ আহত পুলিশকে ধরে নিয়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছে ।আহত পুলিশের সাথে দুজন পুলিশ পাটিয়ে ওরা আবার ভ্যানে ওঠল । থানার সামনে গাড়ি থামাতেই থানার ভিতর থেকে পুলিশ এসে আমাদের মারতে শুরু করল । ওরা আমাদেরকে মারতে মারতে হাজতে ঢুকাল । হাজতে ঢুকার পর অন্যদের অবস্থা দেখতে পারলাম ।বন্ধু নবীনের কান,নাক ফেটে গিয়ে রক্তে গায়ের গেঞ্জি  মেখে  গেছে ।ছোট ভাই সজলের একটা দাত ভেংগে গেছে । আমি ঘাড় নাড়াতে পারছি না । ঘাড়,পিঠ ফুলে গেছে । যারা ছিলাম সবাই গুরুতর আহত । এক ছোট ভাইয়ের কাছে ফোন ছিল । দুই একজন বন্ধুর কাছে সবকিছু জানালাম ।হাজতে ঢোকানোর দশ মিনিট পর কয়েকজন পুলিশ বাহির থেকে গালিগালাজ করছিল । অনেক ভয় করছিল,কারন ওরা বার বার আমাদের মারার জন্য তেড়ে আসছিল । ওই থানার এস.আই অত্যন্ত ভাল লোক ছিলেন । থানায় নিয়ে আসার পর আমাদের কোন প্রকার মারধর করার জন্য তিনি সবাইকে নিষেধ করেছিলেন । যাই হোক রাত তিনটার দিকে আমাদের দুইজন দুইজন করে এস.আই এর সামনে হাজিড় করা হল । আমাকে আর নবিন কে সবার আগে বের করা হল । আমি যেই বের হয়েছি অমনি এক পুলিশ লাঠি দিয়ে আমার হাটুতে এমন জোড়ে মারল যে আমি পড়ে গেলাম । তখন আরেকজন ওনাকে ধমক দিয়ে সরিয়ে নিয়ে আমাকে তুলে এস.আই এর কাছে নিয়ে গেল । রাত তিনটার দিকে নবিন আর ছোট ভাই রুবেল কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল । ওদেরকে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আবার নিয়ে আসা হল । কিছুক্ষন পর ব্যাথা নিয়ে শুয়ে থাকার পড় ঘুমিয়ে পড়লাম । আনুমানিক ভোর
 ৫টা বাজে,তখন এক পুলিশ এসে গালি দিতে দিতে দরজায় লাথি শুরু করে দিল । সবাই ওঠে বসে পড়লাম । সকাল ৬ টার দিকে থানার সব পুলিশ হরতাল নিয়ন্ত্রনে চলে গেল । পুলিশ একবার বলছিল আমাদের ছেড়ে দেবে আর একবার বলছিল কোর্টে চালান করে দেবে  । ঐ সময় বাবা মায়ের কথা,ভবিষ্যতের কথা ভাবছিলাম আর কাদছিলাম ।  থানায় যতক্ষন ছিলাম শুধু কেদেছিলাম  আর আল্লাহ আল্লাহ করেছিলাম । ফাইনাল পরীক্ষা চলছে,এখন যদি চালান করে দেয়া হয় নির্বাচনের আগে আর বের হতে পারব না । ভবিষ্যত শেষ হয়ে যাবে । খারাপ লাগছিল অনেকের জন্যই । আব্বা,আম্মা,দুই ছোট ভাই,নদী সবার জন্য ।কষ্ঠও লাগছিল অনেক কারন কেউ আমদেরকে দেখতে পর্যন্ত আসে নি । আসলে আমাদেরকে দেখার জন্য কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয় নি । সকাল দশটার দিকে পোষ্ট অফিসের চাকরিজিবী আমদের দেখতে আসল। ছোট ভাই সজলের মামা করিমগঞ্জ পোষ্ট অফিসের পোষ্ট মাষ্টার । উনি খবর পেয়ে লোক পাটিয়েছিলেন আমাদের দেখার জন্য । ওরা এসে আমাদের অনেক সান্তনা দিল । আমাদের মেছ মালিকের শ্যালক আওয়ামি লীগ করতেন । তিনি আমাদের কলেজের প্রিন্সিপালকে অনেক অনুরোধ করলেন আমাদের ছাড়িয়ে আনার জন্য । আর ওদিকে তিনি আর একজনকে দিয়ে করিমগঞ্জ আসনের এম পি কে ফোন করালেন । এম পি আমাদেরকে ছেড়ে দেবার জন্য থানায় ফোন করলেন ।আর ওদিকে কলেজের প্রিন্সিপাল বিভাগীয় প্রধানদেরকে নিয়ে এস.পি র সাথে আলোচনা করলে এস.পি আমাদের ছেড়ে দিতে রাজি হয় । বিকাল ৫ টার দিকে কলেজের শিক্ষকেরা আমাদেরকে জেল থেকে বের করে নিয়ে আসল । থানা থেকে বের হয়ে দেখি বন্ধুরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে । ওদেরকে নিয়ে মেছে এলাম । আসার সময় দেখি কলেজের সামনে পুলিশ টহল দিচ্ছে । পড়ে জানতে পেরেছি , ঘটনাস্থলে কিশোরগঞ্জ এর এস.পি ও উপস্থিত ছিল । যারা সিএনজিতে করে আমাদের সাথে যায় নি তারা মেছে ফিরে এসেছিল । ওরা মেছে ফেরার ৫ মিনিট পর পুলিশ এসে মেছ ঘেরাও করে । প্রায় ২০০ পুলিশ মেছ ঘেরাও করে । মেছে যারা ছিল তাদেরকে অনেক টর্চার করা হয় । ১২ তারিখ সকালে কয়েকটি খবরের চ্যানেলে, আমাদের খবর প্রকাশিত হয় । এটা দেখে আমার ছোট মামা বাবাকে জানায়  । আব্বা ছোট মামার কথা বিশ্বাস না করে আমাকে ফোন দেয় । আমার ফোন মেছে মোবাশ্বিরের কাছে ছিল । সে আব্বার কাছে লুকানোর চেষ্টা করলেও আব্বা বিকালের দিকে জানতে পারে । ছাড়া পাবার পর কলেজের স্যারেরা আমাদেরকে খবর দিলেন । স্যারেরা আমাদেরকে ডেকে নিয়ে অনেক কিছু বোঝালেন । তারা এও বললেন যে আমরা পরিস্থিতির স্বীকার,আমরা নির্দোষ তাই আমাদেরকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে । মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে আসলেই আমরা নির্দোষ কারন আমরা ছিনতাই কারী ভেবে দাওয়া করেছিলাম । পুলিশও ভয় পেয়ে সিএনজি থেকে বের হয় নি । তাই আমরা ওদেরকে দেখতে পাই নি । পুলিশ যদি অন্তত একবারের জন্য গাড়ি থেকে নামত তাহলে এরকম বিপদে আমাদের পড়তে হত না । আর যে পুলিশটি গাড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল তার নাকি পা ভেংগে গিয়েছে , এখনো নাকি ময়মনসিংহ হসপিটালে আছে ।

(আমার লেখালেখির কোন অভ্যাস নেই । এটাই আমার প্রথম ব্লগ,এর এটাই আমার কোন ব্লগ সাইটে লেখা কোন কিছু ।এটা আমার জিবনের একটা সম্পূর্ন বাস্তব ঘটনা । কারো মন্তব্য বা লাইক দেয়ার আশায় আমি এটি লেখি নি । ধন্যবাদ.............)